এই নিয়োগ কেলেঙ্কারিতে 17 রকমের দুর্নীতির কারণে হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ সমস্ত নিয়োগ বাতিল করে দিয়েছে।
সুপ্রিম কোর্টের কিছু দিনের জন্য কেসটি স্টে অর্ডার পেলেও সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ এই নিয়োগ কেলেঙ্কারিকে হাইকোর্টের রায়কেই মান্যতা দিয়েছে।
সুপ্রিম কোর্টের অর্ডার অনুযায়ী ২০২৫ সালের ৩১শে ডিসেম্বরের মধ্যে সমস্ত নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে।
রাজ্য সরকারের তরফ থেকে যে আবেদন করা হয়েছিল সুপ্রিম কোর্টে যোগ্য শিক্ষকদের জন্য সবেতনে 31শে ডিসেম্বর পর্যন্ত কাজ চালিয়ে দেওয়ার অনুমতি দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট।
কিন্তু গ্রুপ ডি ও গ্রুপ সি এদেরকে স্কুলে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়নি। যদিও রাজ্য সরকারের তরফ থেকে এদের ব্যাপারে কোনরকম সুপ্রিম কোর্টে আপিল করা হয়নি।
কিন্তু নিয়োগ কেলেঙ্কারি তদন্ত প্রথমে সামনে আসে Rank Jump করে চাকরি পাওয়া।
লক্ষীটুঙ্গা তিনি কেস করেছিলেন হাইকোর্টের সিঙ্গেল বেঞ্চে। তারপর সামনে আসে OMR ম্যানিপুলেশন কেলেঙ্কারি।
তদন্তে সিবিআই তিনটে হার্ডডিস্ক উদ্ধার করে পবন বানশাল নামক এক ব্যক্তির বাড়ির ছাদ থেকে। এই হার্ডডিস্কের উপর ভিত্তি করে প্রথমে গ্রুপ ডি 1911 জনের চাকরি চলে যায়। এদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এরা ওএমআর শিট ম্যানুপুলেট করে চাকরি পেয়েছে।
কিন্তু 1911 জন সুপ্রিম কোর্ট থেকে এস্টে অর্ডার এনে পুনরায় কাজে যোগদান করে। এরা প্রত্যেকেই প্রথম কাউন্সিল এর প্রথম দিনেই জয়েন করেছিল বিভিন্ন স্কুলে।
সুপ্রিম কোর্টে সিবিআই দ্বারা উদ্ধারকৃত হার্ডডিস্ক থেকে পাওয়া OMR এর সত্যতা যাচাই করা যায়নি সুপ্রিম কোর্টে। যার ফলে পুনরায় এরা কাজে যোগদান করে।
কিন্তু এরপরেই শুরু হয় নিয়োগ কেলেঙ্কারির আসল খেলা। তারপর নিয়োগ কেলেঙ্কারির বিভিন্ন রকমের ইস্যু নিয়ে কেস হতে থাকে হাইকোর্টের সিঙ্গেল ও ডিভিশন বেঞ্চে।
এক্সপায়ার প্যানেল, সাদা খাতা, ফর্ম ফিলাপ করেনি এমন লোকও চাকরি পেয়েছে, র্যাঙ্ক জ্যাম, ও OMR ম্যানুপুলেশন এইসব দুর্নীতি নিয়ে কেস হতে থাকে।
হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ যখন 2016 সালের সমস্ত নিয়োগ বাতিল বলে ঘোষণা করেন, তখন হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চের পর্যবেক্ষণে বিচারক বলেন 17 রকমের দুর্নীতির কারণে আমরা এই প্যানেল বাতিল বলে ঘোষণা করছি। আর যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে তাদের টাকা ফেরত দিতে হবে।
কিন্তু হাইকোর্ট যাদেরকে চিহ্নিত করেছে এবং সরাসরি প্রমাণিত করতে পারেনি এমন লোককেও টাকা ফেরত দেয়ার কথা বলা হয়েছে। OMR ম্যানুপুলেশন করে যাদের বিরুদ্ধে চাকরি পাওয়ার অভিযোগ আছে তাদেরকে প্রমাণ করতে পারেনি যে এই ওএমআর শিট উদ্ধার হয়েছে সেটা অরজিনাল।
তবুও CBI এর দেওয়া তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে যাদেরকে অযোগ্য বলে বিবেচিত করেছেন হাইকোর্ট সেটা বড়ই বিচিত্র ব্যাপার।
OMR ইস্যু দিয়ে যাদের চাকরি গিয়েছিল গ্রুপ ডি 1911 জনের এটা কে প্রমাণ করতে পারিনি, সিবিএস সুপ্রিম কোর্টে। তারপরও কি এদেরকে অযোগ্য বলা যায় এটাই কোটি টাকার প্রশ্ন।
এই 1911 জনের মধ্যে থেকে পর্ষদ বা এসএসসি 1741 জনের নাম খুঁজে পেয়েছে যাদের ও এম আর ম্যানুপুলেট আছে CBI এর তথ্যের উপর ভিত্তিতে। শিক্ষক এবং অশিক্ষক কর্মচারী মিলিয়ে মোট ম্যানুপুলেটেট ওএমআর 4091.
যদিও এসএসসি এদেরকে সরাসরি অযোগ্য বলেনি। কিন্তু সাধারণ মানুষের প্রশ্ন যারা ঘন্টা বাজায় তাদের কারণে কখনো শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে না। হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ এ পর্যবেক্ষণে বলেছিল,এই নিয়োগে কারণেই শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। কথাটা কতটা সত্য কতটা মিথ্যা সেটা ভবিষ্যৎ প্রমাণ করবে।
এই 1741 জনের মধ্যে গ্রাজুয়েট আছে প্রায় 60% ও পোস্ট গ্রাজুয়েট 30% বাকি 10% আন্ডার গ্রাজুয়েট। এরা প্রত্যেকেই সাত বছর ধরে চাকরি করছে। এরা স্কুলে গিয়ে জুতো সেলাই থেকে চন্ডিবপাঠ সবকিছুই করে।
তর্কের খাতিরে ধরে নেওয়া যাক এরা সবাই দুর্নীতি করে চাকরি পেয়েছে।
একটা পোস্ট গ্রাজুয়েট ছেলে যদি ঘণ্টা বাজানো চাকরি করার জন্য ঘুষ দিয়ে থাকে, এবং তার বিনিময়ের সে চাকরি পায়। এটাও কি সমাজের একটা অভিশাপ নয়। এমন অনেক গ্রুপ ডি আছে যারা স্কুলের শিক্ষকদের থেকে ডিগ্রিতে অনেক বেশি।
এদের কারণে কখনোই শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারেনা। এযাবৎকালে রাজ্য সরকারের গ্রুপ ডি স্টাফ সর্বদাই শাসক দলের লোকজন চাকরি করে আসছে। পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত অফিস আদালতে প্রায় 90 শতাংশ গ্রুপ ডি স্টাফ শাসক দলের হয়ে থাকে। যেটা বিগত 50বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গ মানুষ দেখে আসছে। যখন বামফ্রন্ট ক্ষমতায় ছিল তারা তাদের লোকগুলোকে গ্রুপ ডি পদে চাকরি দিয়েছে। আর এখন তৃণমূল পার্মানেন্ট না দিলেও ক্যাজুয়াল ভাবে চাকরি দিচ্ছে।
প্রকৃত পক্ষে পশ্চিমবঙ্গে 34 বছরের বামফ্রন্টের শাসন আর তৃণমূলের এই প্রায় 15 বছরের শাসনে সত্যিকারের মেধাবী ছাত্ররা কত পারসেন্ট শিক্ষক হতে পেরেছেন এটাই কোটি টাকার প্রশ্ন।
বামফ্রন্ট আমলে স্কুলে নিয়োগ হতো কমিটির মাধ্যমে। স্কুলের ম্যানেজিং কমিটি শিক্ষক নিতে চাইলে দৈনন্দিন পত্রিকায় বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে শিক্ষকদের ইন্টারভিউতে আসার আহ্বান জানাতেন।
নির্দিষ্ট দিনের শিক্ষকদের ইন্টারভিউ হতো। সেই ইন্টারভিউ বোর্ডে যারা থাকতো তারা যোগ্য প্রার্থীকে নির্বাচন করে শিক্ষক নির্বাচন করত।
কিন্তু এখানেই কোটি টাকার প্রশ্ন এই ইন্টারভিউ গুলো স্বচ্ছ ভাবে হত না। লোকাল এলসিএম যারা ছিলেন তাদের সুপারিশের ভিত্তিতেই শিক্ষক নিয়োগ করা হতো। প্রকৃতপক্ষে যিনি যোগ্য তিনি কখনোই বামফ্রন্টের আমলে কোন স্কুলে চাকরি পাননি এসএসসি হওয়ার আগে পর্যন্ত।
বামফ্রন্ট সরকার বিষয়টি বুঝতে পেরে স্বচ্ছতার সাথে নিয়োগ করার জন্য এসএসসি গঠন করলেন। তারাও তখন মেনে নিয়েছিল স্কুলের ম্যানেজিং কমিটি কখনোই যোগ্য কে নিয়োগ করতে পারেনি।
তারমানে যোগ্য মেধাবী ছাত্ররা তৃণমূলের আমলে না বামফ্রন্টের আমলে শিক্ষক হতে পেরেছেন।
প্রথম এসএসসিতে স্বচ্ছভাবে নিয়োগ হলেও দ্বিতীয় এসএসসি থেকেই দুর্নীতি ঢুকে পড়ে।
তখন আগে দুর্নীতি করতে স্কুল কমিটি । এরপর থেকে শুরু হলো বিভিন্ন চাকরির কোচিং করানো সেন্টার গুলির দুর্নীতি।
যারা এই কোচিং সেন্টারে পড়তো তারাই বেশিরভাগ শিক্ষক হতেন। এই কোচিং সেন্টার গুলির সঙ্গে যারা ক্যান্ডিডেট ছিলেন তাদের এগ্রিমেন্ট হত চাকরি পাইয়ে দেওয়ার।
বামফ্রন্টের এক বড় নেতার ভাগ্নের একটা কোচিং সেন্টার কয়েক হাজার শিক্ষক উপহার দিয়েছে পশ্চিম বাংলাকে। সেই সময় প্রচুর অভিযোগ উঠেছিল শিক্ষা দপ্তরের সঙ্গে কোচিং সেন্টারের ঘনিষ্ঠতার। কিন্তু অভিযোগ কখনো প্রমাণিত হয়নি। তবে একটা জিনিস পরিষ্কার বামফ্রন্টের আমলেও প্রকৃত যোগ্য মেধাবী ছাত্ররা কখনোই শিক্ষক হতে পারেনি। এমনিতেই বামফ্রন্টের আমলে প্রাইমারি থেকে ইংরেজি তুলে দিয়ে শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছিল। আর তৃণমূলের আমলে শিক্ষাব্যবস্থা শব দেহে পরিণত হয়েছে। কিন্তু বর্তমান সময়ে নিয়োগ দুর্নীতির বিচারকদের রায় দেখে সমাজের মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছে। একই দোষে দোষী একজন শাস্তি পাচ্ছে আর একজন পাচ্ছে না। এই নিয়োগ কেলেঙ্কারি ইস্যুটা বিচার ব্যবস্থার কাছে একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেখানে আইনে বলা আছে যতক্ষণ পর্যন্ত দোষী প্রমাণিত না হচ্ছে কাউকে শাস্তির প্রদান করা যাবে না। কিন্তু এখানে দোষী প্রমাণিত হওয়ার আগেই শাস্তি প্রদান করা হয়ে যাচ্ছে। আর একই দোষের দোষী এমন অনেকের এখনো শাস্তির ব্যবস্থা করাই হয়নি। অথচ দেখুন একটা পোস্ট গ্রাজুয়েট ছেলে সাত বছর ঘন্টা বাজানো চাকরি করার পরে যদি তার চাকরি চলে যায় এর জন্য কি সমাজ দায়ী নয়।
তর্কের খাতিরে ধরে নিয়ে যাক, তারা অসৎ উপায়ে চাকরি পেয়েছে। তাদের চাকরি চলে যেতে পারে এটা স্বাভাবিক। কিন্তু তাদেরকে টাকা ফেরতের কথা বলা হচ্ছে, এটা কতটা অমানবিক। এমন অনেক মানুষ আছেন যারা ভিটেবাড়ি বিক্রি করে অসৎ উপায়ে চাকরি পেয়েছে। তাদেরকে যদি বলা হয় টাকা ফেরত দিতে তারা কি সেটা দেওয়ার মতো অবস্থায় আছে। এমনিতেই বিগত দুবছর ধরে চাকরি বাঁচানোর জন্য হাইকোর্ট সুপ্রিম কোর্টে কেস করে করে তাদের ভান্ডার শূন্য।
একজন খুনি আসামি জেলের মধ্যে যখন থাকে তখন সে সশ্রম কারাদণ্ড ভোগ করেও মধ্যে যে কাজ করে তার টাকা সে পায়।
,,,ন্যূনতম মজুরি আইন,, বলে যে ধারাটা ভারতবর্ষের সংবিধান তৈরি করেছে সেখানে মানুষ কাজের বিনিময়ে অর্থ পাবে এটাই আইন।
কিন্তু যাদেরকে টাকা ফেরত দেয়ার কথা বলা হচ্ছে তারা কি ন্যূনতম কাজের বিনিময়ে অর্থ পেতে পারেনা।
2016 সালের SSC নিয়োগ কেলেঙ্কারির বিষয়টা একেক জন বিচারক এক একজন উকিল বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছে।
0 coment rios: